আমাদের সময়-ল্যাবএইড সাহিত্য সম্মাননা পেলেন দুই বাংলার ৫ কীর্তিমান (১৯/০৩/২০১৪)
নিজস্ব প্রতিবেদক
বৈদগ্ধের ছোঁয়া পেলে একটি ঘরোয়া সমাবেশও হয়ে উঠতে পারে ধ্রূপদী। গতকাল মঙ্গলবার আমাদের সময় মিলনায়তনে দুই বাংলার খ্যাতিমান কবি ও কথাশিল্পীদের ভাবনাবিনিময়মূলক অনুষ্ঠানটি ছিল তেমনই একটি আয়োজন। অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘বাংলা সাহিত্যের এপার ওপার’। আমাদের সময়-ল্যাবএইড আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে আলোচকরা বলেন, সাহিত্যের কোনও ভৌগোলিক মানচিত্র নেই। সীমান্ত, কাঁটাতারের বেড়া, প্রাচীর বা দেয়াল এপার বাংলা আর ওপার বাংলার মধ্যে এখন আর কোনও বাধা নয়। বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বেলাল চৌধুরী, মৃণাল বসুচৌধুরী, শচীন দাশ, কামাল চৌধুরী ও শ্যামলকান্তি দাশকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয় অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত মৃণাল বসুচৌধুরীর ‘নির্বাচিত কবিতা’ এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত কামাল চৌধুরীর ‘নির্বাচিত কবিতা’ বই দুটির পাঠ-উন্মোচন।
‘এইপার— ওইপার— কোনো এক পারাপার থেকে/রাত্রিরে ডাকিছে দিন,— দিনেরে যেতেছে রাত্রি ডেকে।’ জীবনানন্দ দাশের কবিতার এই চরণ উত্কীর্ণ ছিল ব্যানারে। সেই পরম্পরায় আমাদের সময় সম্পাদক কবি আবু হাসান শাহরিয়ার অনুষ্ঠানের নান্দিপাঠ ঘটান। তিনি বলেন, মানচিত্র উপেক্ষা করে এক ভাষার পাঠক অন্য ভাষার সাহিত্যের যেভাবে যায়, বাংলা ভাষার এপার-ওপার দূরত্বমোচনও সেভাবেই ঘটে এসেছে, ঘটে চলেছে, ঘটবে। পাঠের আগ্রহ থাকলে বহু যুগের ওপারের কবির সঙ্গেও পাঠকের যোগাযোগ ঘটে। নইলে আমরা আড়াই হাজার বছর আগের গ্রিক কবি সাফোকে চিনি কীভাবে? কীভাবে এই যোগাযোগ আরও বাড়ানো যায়, তা নিয়েই আজকের এ ভাবনাবিনিময়। এ যোগাযোগ কেমন ছিল আগে, তা নিয়েও।
এর জের ধরে ‘এক সময় দুই কবি’— এপারের কবি বেলাল চৌধুরী আর ওপারের কবি মৃণাল বসুচৌধুরীর স্মৃতিচারণে জমে ওঠে বিদগ্ধ আড্ডা।
এমন একটি আয়োজনের জন্য আমাদের সময়কে ধন্যবাদ জানিয়ে কবি বেলাল চৌধুরী বলেন, এ পত্রিকার সম্পাদক আবু হাসান শাহরিয়ার যখন যা করেন, তাই ব্যতিক্রমী ব্যাপার হয়ে যায়। ভারত উপমহাদেশে ধর্মের নামে মানুষকে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে মন্তব্য করে বেলাল চৌধুরী আরও বলেন, যখন ভারত থেকে মুসলমানরা এদেশে চলে আসতে থাকে তখন আমার কলকাতায় চলে যাওয়া সহজ ঘটনা ছিল না। তবে সেখানে আমি অনেক মানুষের ভালবাসা পেয়েছি। মানুষে-মানুষে এই যে ভাবনাবিনিময়, সাহিত্য-সংস্কৃতির আদান-প্রদান— দেশ ও জাতির উন্নয়নের জন্য এর প্রয়োজন অসীম। দুই বাংলায় প্রথম কবিতার কাগজটি ঢাকা থেকে বের হয়, এই তথ্য দেন বেলাল চৌধুরী। তার স্মৃতিকথনে উঠে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নিজের জেলজীবনের কথাও।
ওপার বাংলার কবি মৃণাল বসুচৌধুরী বলেন, জন্মের পর প্রথম ‘মা’ শব্দটি উচ্চারণ করার সময় থেকেই বাংলা আমার ভাষা। এ ভাষায় যারা কথা বলেন, এ ভাষাকে পরিচর্যা করে বাঁচিয়ে রাখেন— তারা আমার আত্মার আত্মীয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে ভাগ হয়ে যাওয়া দুই বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরষ্পরের কাছে সমানভাবে প্রিয়। ও পারের দূর্গাপুজো আর এ পারের ঈদ আসলে দুই পারেরই উত্সব। তিনি আরও বলেন, দুই বাংলার মধ্যে সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে দূরত্ব ছিল প্রথমদিকে, তা নেই। এখন দুই বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমীরা পরষ্পরের চেতনা ও মনন সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে আদানপ্রদানও অনেক বেড়েছে। শুধুমাত্র খ্যাতিমান কবিরাই নয়, তরুণদের কবিতাও— দুই বাংলার খোলা জানালা দিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বত্র।
ওপারের কথাশিল্পী শচীন দাশ বলেন, বঙ্গ দুই, ভূমি দুই, কিন্তু বাঙালির ভাষা এক, ভাবনা এক। একই ভাষায় আমাদের কথা। একই ভাষায় আনন্দ-দুঃখ ও বিষাদের প্রকাশ। এই যে বিষাদ-দুঃখ-আনন্দ ও জীবনের জটিলতা এসব দিয়েই দুই বঙ্গের সাহিত্য। করপোরেট বিশ্ব দেশে-দেশে ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানছে। তাই, উপমহাদেশের প্রায় ছাব্বিশ-সাতাশ কোটি কোটি বাঙালির কাছে সাংস্কৃতিক এই আদান প্রদান এই মুহূর্তে খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। আমাদের সময়ের এ অনুষ্ঠানে আমরা আশাবাদী।
কবি কামাল চৌধুরী বলেন, এবং তাকে সম্মাননা দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আবু হাসান শাহরিয়ার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাদের সময় কবিতাবান্ধব হয়ে উঠেছে। তিনি তার নির্বাচিত কবিতা কীভাবে প্রকাশিত হল তার স্মৃতিচারণ করেন। এপার-ওপারের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানকে আরও বেগবান করতে বইয়ের বিপণনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, শুধু বইপ্রকাশই যথেষ্ট নয়, প্রকাশিত বইটি যেন পাঠকের জন্য সহজপ্রাপ্য হয়, সেই চেষ্টাও নেওয়া দরকার।
ওপারের কবি শ্যামলকান্তি দাশ বলেন, আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি কাঁটাতারের বেড়া কোনও বাঁধা নয়। মনের সীমান্ত যদি উন্মুক্ত থাকে, তাহলে কোনও প্রতিবন্ধকতাই আমাদের দমাতে পারবে না। সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির দরজা কোনও বিধিনিষেধে বন্ধ হয় না। আমাদের সময়কে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এই ভাবনাবিনিময় সবুজ বাতাস ছড়াচ্ছে। এরকম বাতাসে এপারের বই ওপারে উড়ে যায়, ওপারের বই এপারে উড়ে আসে।
গল্পকার আবু সাঈদ জুবেরী বলেন, পাশাপাশি প্রবাহমান দুই নদীর মধ্যখানের জমিকে বলে দোয়াব। দুই দেশের সাহিত্যের মাঝখানে এইরকম একটি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছিল একাত্তর-পূর্ব দেশে। আমরা তা অতিক্রম করেছি অধিকতর প্রগতিপূর্ণ চিন্তায়। সেই জন্যই এখন জানতে অসুবিধা হয় না যে একজন মৃণাল কিংবা শচীন কিংবা শ্যামল কী লিখছেন। এপার-ওপারের সবার মধ্যেই এই আগ্রহ থাকতে হবে সাহিত্যের স্বার্থে।
কবি ফরিদ কবির বলেন, পশ্চিমবাংলার কবি-লেখকদের সঙ্গে বাংলাদেশের কবি-লেখকদের একটা যোগাযোগ সবসময়ই ছিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ ও বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে ওপার বাংলার অনেকের সঙ্গেই ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। তবে, সেটা ছিল খুবই ক্ষীণ পর্যায়ে। আমি মনে করি, ১৯৮৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের ‘আবৃত্তিলোক’ আয়োজিত সাতদিনব্যাপী ‘কবিতা উৎসব-এর মাধ্যমে দুই অঞ্চলের কবি-লেখকদের যোগাযোগ একটা বড় ক্ষেত্র তৈরি হয়। আমি বলব, দুই অঞ্চলের কবি-লেখকদের যোগাযোগের বর্তমান এই ক্ষেত্র তৈরির ব্যাপারে সেটা ছিল প্রথম মাইলফলক। ওই উৎসবে বাংলাদেশ থেকে শামসুর রহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, রুবী রহমান, আবু হাসান শাহরিয়ার আমরা বেশ কজন কবি অংশ নিয়েছিলাম। প্রেমেন্দ্র মিত্র, অরুণ মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ ওপারের অনেক কীর্তিমান কবি সেই উত্সবে যোগ দিয়েছিলেন। তখন থাকলেও এখন এপার-ওপারের মধ্যে অপরিচয় অনেক কমে এসেছে। আজকের এই অনুষ্ঠানটিতেও কোনও এপার-ওপার আমার চোখে পড়ছে না। সাহিত্যের জন্য এটা শুভ লক্ষণ।
কবি হারিসুল হক বলেন, ওপার বাংলার কোনও কবির সঙ্গে কথা আরম্ভ করতেই উঠে আসে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কী? পার্শ্ববর্তী দেশে বাংলা ভাষাকে হিন্দির ঘুণে খাচ্ছে। এদিক থেকে বাংলাদেশ নিরাপদ।
কবি রহমান হেনরী বলেন বাংলাদেশ ছাড়াও বাংলা সাহিত্যের চর্চা আছে ত্রিপুরা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গের নগরকেন্দ্রিক কলকাতায় এবং দার্জিলিংসহ উত্তরবাংলায়। তবে অঞ্চলগুলোর সাহিত্যে সুচিহ্নিত বৈশিষ্ট্য আছে। এর বাইরে প্রবাসী বাঙালীদের অঞ্চল আছে। এইসবগুলো প্রবাহের সঙ্গে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের পারস্পারিক ভাবনাবিনিময় ও যোগাযোগের গুরুত্ব আছে বলে আমি মনে করি। তাতে বিশ্বসাহিত্যের উপযোগী হয়ে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ও উন্নয়ন ঘটবে।
কবি সৈকত হাবিব বলেন, আমাদের সময়ের এই আয়োজনের বিশালত্ব এই যে, বাংলা সাহিত্যের এপার-ওপারের স্মৃতি ও বাস্তব এখানে খুব নিবিড়ভাবে উঠে আসছে।
কবি সুহিতা সুলতানা বলেন, আমাদের সময় আয়োজিত বাংলা সাহিত্যের এপার ওপার অনুষ্ঠান নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক। ইতিমধ্যে ‘আমাদের সময়’ এ দেশের পাঠকের মেধা ও মননকে স্পর্শ করেছে। এপার বাংলা ওপার বাংলার সাহিত্যের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের প্রয়োজন আছে।
কবি ও নাট্যকার ফরিদ আহমদ দুলাল বলেন, সাহিত্যের এপার ওপার বলে কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। সৃষ্টি যেখানেই হোক তার ব্যাপ্তি বিশ্বব্যাপী, আর ভাষার সীমাবদ্ধতার কথা মানলে বলা যায় যতদূর বাংলা ভাষা ততদূর বাংলা সাহিত্যের বিস্তার। তবে রাজনৈতিক অথবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিষয়টি এলেই এপার বাংলা ওপার বাংলার ব্যাপ্তি ও বিস্তার ভিন্ন হয়ে যায়।
প্রকাশক খন্দকার সোহেল বলেন, কবি, কবিতা, কবিতাভাবনা কিংবা সাহিত্যভাবনা— নান্দনিক কিংবা সৃজনশীল বিষয় নিয়ে ভাবনাবিনিময় খুবই সময়োপোযোগী আয়োজন। প্রযুক্তির বিকাশমান এই সময়ে দুই বাংলার কবি লেখকদের এই ধরনের আয়োজন সৃজনশীল সাহিত্যচর্চার পথকে আরও গতিশীল করবে। কবি কামাল চৌধুরীর সূত্র ধরে বইবিপণনে আন্দোলন গড়ে তুলতে আমাদের সময়কে ভূমিকা রাখার আহবান জানান তিনি।
বাচিকশিল্পী মনির হোসেন বলেন, কাঁটাতারের বেড়ায় বাংলা ভাগ হলেও বাঙালির ভাবনা ও ভাষা অভিন্ন। আমি যে তিতাসের পারে জন্মেছি সেই তিতাসের পূর্ব দিকে বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে রয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরেক সম্ভাবনাময় সৃজনশীল প্রান্তর ত্রিপুরা। সেখানেও বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি করছেন অনেকে। এখানে ত্রিপুরার কোনও কবি বা লেখক থাকলে আরও উপভোগ্য হত এ আয়োজন।
অনুষ্ঠানে বেলাল চৌধুরী, মৃণাল বসুচৌধুরী, শচীন দাশ, কামাল চৌধুরী ও শ্যামলকান্তি দাশের হাতে আমাদের সময়-ল্যাবএইড সম্মাননা স্মারক তুলে দেন যথাক্রমে আমাদের সময় সম্পাদক আবু হাসান শাহরিয়ার, ভাষা সম্পাদক কবি রফিক আজাদ, নির্বাহী সম্পাদক আবু সাঈদ জুবেরী, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার ও ল্যাবএইড’র ব্রান্ড এন্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার সাইফুর রহমান লেনিন।
রফিক আজাদের ধন্যবাদজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এপার-ওপার এই প্রাণবন্ত ভাবনাবিনিময়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মেসবাহ য়াযাদ।
Date of Published : 3/22/2014 1:20:50 PM. .
Back